হারানো আমি

আজ অনেক দিন পর ময়মনসিংহ পার্কে হাঁটতে বের হয়েছি । হাঁটতে ভালই লাগছে। সেই সাথে এক ধরনের শূন্যতাও গ্রাস করছে। কাউকে হারানোর শূন্যতা।

ময়মনসিংহ পার্কের এই পরিচিত রাস্তাগুলোতে অনেকবার টুসির হাত ধরে হেঁটেছি । আজ আর টুসি নেই । তাই একাই হাঁটতে হচ্ছে ।

টুসিকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি, প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল ।

পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কালামের ছোট চায়ের দোকানটা চোখে পড়লো । অনেকদিন এই দোকানটাতে চা খাওয়া হয় না । ১২-১৩ বছরের কালাম নামের এই ছেলেটা অসাধারণ চা বানায় ।

টুসি আর আমি এই দোকানটাতে অনেকবার চা খেয়েছি । টুসি যে স্যার এর কাছে Physics প্রাইভেট পড়তো সেই স্যার এর বাসা ছিল পার্কের কাছেই । বিকালবেলা ওর প্রাইভেট শেষ হলে মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন দিয়া পার্কে আসতে বলতো । বিকালবেলা ওর সাথে পার্কে হাঁটতে এসে প্রায়ই কালামের দোকানে চা খাওয়া হতো । <img src=”http://devinci.wen.ru/lovepost1.jpg”></img&gt;

দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালাম ডাকল, `শাফিন ভাই,কই যান?’

এইতো, হাঁটতেছি ।‘

চা খায়া যান । অনেকদিন ধরে তো আসেন না । আফা আহে নাই ?’

কালামের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দোকানে গিয়ে বসলাম ।

দোকানে গিয়ে বসতেই কালাম এক কাপ চা বানিয়ে হাতে দিল ।

চা খেতে গিয়ে টুসির কথা প্রবলভাবে মনে হচ্ছিলো ।

ও আমার জীবনে কেন এলো , আর কেনইবা কষ্ট দিয়ে চলে গেলো ?

মনে হচ্ছে , এইতো সেদিনের ঘটনা । পাশের বাসায় আসা নতুন ভাড়াটিয়ার সুন্দরী মেয়েটিকে হঠাৎ আমার নজরে পড়লো । সে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার । কলেজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরি তখন পাশের বাসার ২য় তলার বারান্দায় চোখ চলে যায় । দেখলাম , উদাস উদাস ভাব নিয়ে একটি মেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে কেমন যেন ভালো লেগে গেলো । তারপর মাঝে মাঝেই মেয়েটির সাথে রাস্তায় দেখা হতো । কখনও দেখতাম বিকালে প্রাইভেটে যাচ্ছে , কখনও দেখেছি স্কুল টাইম এ রিকসার জন্য দাড়িয়ে আছে ।

একদিন হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল টুসিকে রিকসার পেছন পেছন ফলো করে ওর স্কুল পর্যন্ত যাবো । যেই ভাবা সেই কাজ । ওর স্কুল টাইম এ বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে বের হলাম । কিছুক্ষন পরই টুসি বাসা থেকে বের হয়ে রিকসায় উঠলো । আমিও সাইকেল নিয়ে ফলো করে ওর স্কুল পর্যন্ত গেলাম । ও স্কুলে ঢুকে গেলে আমি আবার বাসায় চলে আসলাম । এভাবে মাঝে মাঝেই ফলো করতাম । একদিন ফলো করছি এমন সময় দেখলাম , টুসি বারবার রিকসার পেছন দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছে । বুঝতে পারলাম ফলো করার বেপারটা ও ধরে ফেলেছে । তাই , ওই দিনের পর থেকে ভয়ে আর ফলো করি নাই । কিন্তু আমি যে টুসির প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছি সেটা আস্তে আস্তে অনুভব করলাম । মনে মনে চিন্তা করছিলাম , কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে । আল্লাহের রহমতে একটা রাস্তা পেয়েও গেলাম ।

আমার এক মেয়ে ফ্রেন্ড টুসিদের বাসার নিচের তলার ফ্ল্যাট এ থাকতো । সুযোগ বুঝে আমার ফ্রেন্ডকে একদিন সব খুলে বললাম । ওর সাহায্যেই আমি পরে টুসির মোবাইল নাম্বারটা পেয়ে গেলাম । শুরু হল মেসেজ পাঠানো । টুসিকে মাঝে মাঝেই মেসেজ পাঠাতাম । একদিন সাহস করে কল করে বসলাম । ও ফোন রিসিভ করার পর ভদ্র ভাষায় কিছু গালি শুনতে হল । তবুও নাছোড়বান্দার মত লেগেই রইলাম । মাঝে মাঝেই কল করতাম । কিন্তু ও রিসিভ করতো না । তারপর কলেজ এ পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় ব্যস্ততায় টুসির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । ওকে পাবার আশাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম । পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর হঠাৎ একদিন টুসির নাম্বার থেকে আমার মোবাইল এ একটা কল আসে ।

আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম । ভয়ে ভয়ে কলটা রিসিভ করলাম । রিসিভ করার পর টুসি যে কথাগুলো বলেছিল সে কথাগুলো হচ্ছে :

আপনি কে সে সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি । তিথি আপু (আমার সেই মেয়ে ফ্রেন্ড ,যে টুসিদের বাসার নিচের ফ্ল্যাট এ থাকে) আমাকে সব বলেছে ।

কাউকে ভালো লাগলে সেটা বলতে হয় । কাপুরুষের মত ফোন দিয়ে কাউকে বিরক্ত করে ভালবাসা আদায় করা যায় না । আর কাউকে ভালবাসতে হলে তাকে বুঝতে হয় , ভালো লাগতে হয় , যাচাই করতে হয় । তারপর তো ভালবাসা । হুট করে ভালবাসার কথা বললেই ভালবাসা যায় না । ‘

এই কথাগুলো বলে ও লাইন কেটে দেয় ।

এভাবেই আমাদের রঙিন স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে ছিল । ওই দিনের ফোন কলের পর থেকে আমি সব সময় টুসির পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । মাঝে মাঝেই ওর স্কুল এ যাওয়ার সময় সাইকেল দিয়ে রিকসার সাথে সাথে ওর স্কুল পর্যন্ত গিয়েছি । বিকালেও প্রায়ই ওর প্রাইভেট এ যাওয়ার সময় সাথে সাথে গিয়েছি । ও শুধু পিছনে ফিরে মুচকি হাসত । এই মুচকি হাসিটাই আমার কাছে চাঁদের আলো মনে হতো ।

এভাবে চলার দুই মাস পর টুসিকে সরাসরি প্রপোজ করলাম । ও কিছু না বলে শুধু একটু হেসেছিল । ২ দিন পর ও যখন আমার প্রস্তাবে হ্যাঁ বলল তখন আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝানো যাবে না ।

আমাদের দিনগুলো স্বপ্নের মত এগিয়ে যেতে লাগলো । টুসির ভালবাসায় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হতো ।

আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই টুসি জিজ্ঞেস করতো , আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে নাতো ?’

আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলতাম , আমার এই লক্ষ্মী পাগলীটাকে ছেড়ে আমি কখনোই যাবোনা ।‘

এইভাবে স্বপ্নের ঘোরে অনেকগুলো দিন কেটে গেলো । টুসি এস .এস .সি তে জি .পি . এ – ৫ পেয়ে ভিকারুন্নিসা কলেজ এ ভর্তি হল । ও ঢাকা চলে যাওয়ার আগের দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল । ও ঢাকায় ওর খালার বাসায় থাকতো । কলেজ বন্ধ হলে ও যখন ময়মনসিংহ আসতো তখনি শুধু আমাদের দেখা হতো । আর ফোন এবং ফেসবুক এ তো সব সময় যোগাযোগ থাকতোই ।

আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এইচ .এস . সি পরীক্ষা নিয়ে । কেটে যেতে লাগলো দিনগুলো ……….

এইচ.এস.সি পরীক্ষা হয়ে গেল । জি .পি . এ – ৫ পেয়ে ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলাম । তারপর শুরু হয়ে গেল ভর্তি যুদ্ধ । চান্স পেলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে । নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিন আর টুসির ভালবাসা নিয়ে মুহূর্তগুলো ভালই কাটছিল । কিন্তু আমাদের সুখটা আর বেশি দিন স্থায়ী হল না । আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে টুসির ফ্যামিলিতে জানাজানি হয়ে গেল । ফ্যামিলির চাপে এক সময় টুসি আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিল । ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু , কিছুই ঠিক হল না । জীবনটা কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো হঠাৎ করেই । দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিলো । মোবাইলে কল আসলে মনে হতো এই বুঝি টুসি ফোন করলো । কিন্তু , সেই আশা আশাতেই থেকে যেতো । শুধু ভাবতাম , ফ্যামিলির চাপে ও আমাকে এত সহজেই ভুলে গেলো ।

প্রায় দেড় মাস পর যখন সত্যি ঘটনাটা জানতে পারলাম তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ।

আসলে , টুসি আরেকটি ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল । তাই , ফ্যামিলির চাপের অজুহাত দেখিয়ে ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো । হিমি নামে টুসির এক বান্ধবীর কাছ থেকে যেদিন কথা গুলো শুনেছিলাম সেদিন কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছিলো এটা একটা স্বপ্ন , আর স্বপ্নটা বুঝি এখনি ভেঙে যাবে । যেই মানুষটাকে এত বেশি বিশ্বাস করতাম , এত বেশি ভালবাসতাম সেই মানুষটা আমাকে আজ এভাবে কষ্ট দিলো ।

ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে সেদিনই টুসিকে ফোন দিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে । কিন্তু , সব কিছু ভুল প্রমাণিত করে টুসি যখন সত্যি ঘটনাটি স্বীকার করলো তখন আমি কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । ইচ্ছা হচ্ছিলো দৌড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই ।

‘ কি দোষ ছিল আমার ? কি ভুল করেছিলাম আমি ? আমিতো শুধু ভালবেসেছিলাম । ‘

‘ হে আল্লাহ , আমার ভালোবাসাটাই কি দোষ ছিল । এটাই কি আমার ভুল ছিল । ‘

আসলে , এরকম দুঃখ পাওয়াটাই মনে হয় ভালোবাসা ।

কথাগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না । ঘর ভাঙল কালামের ডাকে ।

-শাফিন ভাই , আপনের চা তো অনেক আগেই ঠাণ্ডা হইয়া গেছে । আরেক কাপ চা বানায়া দেই ?

-না থাক । আজকে আর লাগবে না । আরেকদিন এসে খাবো ।

চায়ের কাপটা রেখে টাকা দিয়ে যখন চলে আসছিলাম , তখন আবার পিছন থেকে কালাম ডাক দিলো ।

-শাফিন ভাই , একটু শুইনা যান ।

যাওয়ার পর কালাম আমাকে ওর দোকানের পিছনে একটা গোলাপ গাছ দেখাল । গাছটাতে একটা গোলাপ ফুটে আছে । তখনি আমার গাছটার কথা মনে পড়লো । আমিতো একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম । গত বছর , বৃক্ষ মেলা থেকে এই গোলাপ গাছটা কিনে টুসি এখানে এনে রোপণ করেছিলো । বলেছিল , আমাদের ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ গাছটা এখানে থাকবে । গাছটা ঠিকই রয়ে গেছে , কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা হারিয়ে গেছে ।

-শাফিন ভাই , আরেকদিন আসার সময় আফারে সাথে কইরা নিয়া আইসেন । আফা গাছে ফুল দেখলে অনেক খুশি হইব ।

সে কি আর কখনো আসবে এই দোকানে চা খেতে ? হয়তো আসবে অন্য কারো হাত ধরে ……… কথাগুলো চিন্তা করতে করতে হেঁটে যাচ্ছি পার্কের সেই চিরচেনা পথটি ধরে……………