নক্সী- কাঁথার মাঠ-১১

“ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?

বন-গেয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা চরের খামার ভূয়ে।”

“কি বলিলা বছির মামু?” উঠল রূপাই হাক ছাড়িয়া,

আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া।

পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে,

বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি,আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে!

লম্ফে রূপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা,

ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা।

কোথায় রল রহম চাচা ,কলম শেখ আর ছমির মিঞা,

সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া?

বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর গাঁয়ে,

এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে?

“আলী-আলী” হাঁকল রূপাই, হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,

হুঞকারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে!

ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি;

আকাশ হতে ভাঙছে ঠাটা , মেঘে মেঘে লাগছে বাড়ি।

ডাক শেনে তার আসল ছুটে রহম চাচা,  ছমির মিঞা,

আসল হেকে কাজেম খুনী নখে নখে আঁচড় দিয়া ।

আসল হেকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পরি,

এক নিমিষে গাঁয়ের লোকে রূপার বাড়ি ফেলল ভরি।

লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেটেল,মমিনপুরের চর দখলে,

এক লাঠিতে একশ লোকের মাথে যে জন আসল দলে।

দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো,বয়স তাহার যদিও আশি,

গায়ে তাহার আজো আছে একশ লড়ার দাগের রাশি।

গর্জি উঠে গদাই ভুঁঞা,মোহন ভুঁঙার ভাজন বেটা,

যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা।

সব গাঁর লোক এক হল আজ রূপার ছোট উঠান পরে,

নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ খেলানো বাঁশীর স্বরে।

রূপা তখন বেড়িয়ে তাদের বলল,”শোন ভাই সকলে,

গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে।”

বছির মামু বলছে খবর-মোল্লারা সব কালকে নাকি;

আধেক জমির ধান কেটেছে,আধেক আজো রইছে বাকি।

“মোদের খেতে ধান কেটেছে,কালকে যারা কাঁচির খোচায়;

আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায়।”

থাম্ল রূপাই-ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া,

নাগ-নাগিনীর ফনায় যেমন  তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া।

গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাঠিম হেন ঘোড়ার লাঠি,

রোহিত মাছের মতন চলে , লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি।

রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে,”থাল বাজারে থাল বাজারে,

থাল বাজারে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে।

হানরে লাঠি- হানরে কুঠার,গাছের ছ্যান আর রাম- দা – ঘুরা,

হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয়্রে তোরা।”

“আলী!আলী!আলী! আলী!!!” রূপার যেন কন্ঠ ফাটি,

ইস্রাফিলের শিঙ্গা  বাজে কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি।

তারি সুরে সব লেটেলে লাঠির পরে হানল লাঠি,

“আলী, আলী” শব্দে  তাদের আকাশ যেন ভাংবে মাটি।