নক্সী- কাঁথার মাঠ-১২
রূপাই গিয়াছে “কাইজা” করিতে সেই যে সকাল বেলা,
বঊ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকের মেলা।
কত লোক আসে কত যায়, সে কেন আসেনা আজ,
তবে কি নসিব মন্দ, মাথায় ভাংঙ্গিবে বাজ!
বালাই, বালাই, ওইযে যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া,
আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই? নেচে উঠে তার হিয়া।
এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়ায়ে হাত,
কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাত।
আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে সে ত ও নয়,
আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয়।
লোহুর সাগরে সাঁতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা,
রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা।
পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শতগু্ণ,
রাত এসে তার ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন!
ঘরের মেঝেতে সপ্টি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা,
সেলাই করিতে বসিল সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা।
পাতায় পাতায়, খস খস খস শুনে কান খাড়া করে,
যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে।
তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার;
আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার।
কেন আসেনা নারে! সাজুর যদি গো পাখা দিত আজ বিধি,
উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি।
নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী ফুল,
প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল।
আঁকিল তাদের বিয়ের আসর, আঁকিল রূপার বাড়ি,
এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি।
দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে–রূপাই আসিছে বটে,
“এতক্ষণে এলে? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে।
আর যাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো,
তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বঊ, ছেলেমেয়ে আছে কারো।”
রূপাই কহিল কাঁদিয়া ,”বউগো ফুরায়েছে মোর সব,
রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব।”
লড়ায়ে আজিকে কত মাঠা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে,
আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙ্গেছে তাতে।
লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী,
বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি।
আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানিতাম,
হায় হায় সখি,নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম।”
বউ কেঁদে কয়,” কি হয়েছে বল,লাগিয়াছে বুঝি কোথা,
দেখি! দেখি!! দেখি!!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝি তার ব্যথা।”
“লাগিয়াছে বউ,খুব লাগিয়াছে,নহে নহে মোর গায়,
তোমার শাড়ির আঁচল ছিড়েছে, কাঁকন ভেঙ্গেছে হায়!
তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়,ছিড়েছে গলার হার,
তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর।
আজ “কাইজার” অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু।
এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রয়েছে লোহু।
থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি,
খোজ পেলে পরে এখনি আমায় ধরে নিয়ে যাবে টুটি!
সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা তথা,
আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা।
আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়,
যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়!
হায় বনফুল,যেই ডালে তুমি দিয়েছিলে পাতি বুক,
সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ।
ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি,
বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি!