নক্সী- কাঁথার মাঠ-১২
ভাইও থাকিলেও ভাই-এর বউরে রাখিত যতন করি,
তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি।
আমি যে যাইব ভাবি নাক , সাথে যাইবে কপাল লেখা,
এ যে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে একে গেনু তারি রেখা।”
সাজু কেঁদে কয়,”সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি,
হয়তো তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি।
সে দুখেরে আমি কি দিয়ে ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া ,
এ পোড়া রূপেরে কি দিয়ে ঢাকিব- ভেবে মরে মোর হিয়া।
তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে
তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোনখানে!”
রূপা কয়,” সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই,
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে,পাথর ভাসায় জলে,
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে।”
এমন সময়ে ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি,
রূপা কয়,”সখি!যাই-যাই আমি-রাত বুঝি নাই বাকি!”
পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়; সাজু কয়,ওগো শোন,
আর কিগো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন?
দীঘল রজনী — দীঘল বরষ – দীঘল ব্যথার ভার,
আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার?”
রূপা ফিরে কয়,” না কাঁদিয়া সখি,পারিলাম নাক আর,
ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়াল ধার।”
“এই শেষ কথা!”সাজু কহে কেঁদে,”বলিবেনা আর কিছু?”
খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু,
“মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি,যদি কোন ব্যথা লাগে,
দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে।
সিন্দুরখানি পরিও ললাটে – মোরে যদি পড়ে মনে,
রাঙা শাড়িখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী কোণে।
মোর কথা যদি মনে প্রে সখি, যতনে বাঁধিও চুল,
আলসে হেলিটয়া খোঁপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল।
যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে – না শুনি আমার বাঁশী,
বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুক্ষে মেখে রাঙা হাসি।
চেয়ো মাঠপানে – গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান;
কান পেতে থেকো, যদি শোন কভু সেথায় আমার গান।
আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া,
মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া !”
ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে,
দিনের তরনী পূর্ব সাগরে দুলে উঠে রাঙ্গা পালে।
রূপা কহে,”তবে যাই যাই সখি,যেটুকু আঁধার বাকি,
তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি।”
পায়ে পায়ে পায় কতদূর যায়,তবু ফিরে ফিরে চায়;
সাজুর ঘরেতে দীপ নিভু নিভু ভোরের উতলা বায়!