নক্সী-কাঁথার মাঠ-১৩
কেউ কেউ বলে ,” তাহারি মতন দেখিছিনু একজনে,
আমাদের সেই ছোট গাঁর পথে চলে যেতে আনমনে।”
“আচ্ছা, হতাহারে শুধাওনি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী,
পরদেশে সে যে কোন প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি?”
গাঙে-পড়া-লোক যেমন করিয়া তৃণ্টি আঁকড়ি ধরে,
তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে।
মিথ্যা করেই তারা বলে,” সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে,
খবর দিয়েছে, বুরী যেন আর কাঁদে না তাহার আঁশে!”
এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা,
মুহূর্তে যেন মুছাইয়া দেয়কত বরষের ব্যথা।
মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে “ভাবিস না মাগো আর,
বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোরে-খবর পেয়েছে তার।”
মেয়ে শুধু দুটি ভাষা ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে;
কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে।
গণিতে গণিতে শাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা।
আজকে কত্না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীণে,
সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে ব্দনা বিয়ের দিনে।
তারপর সেই হাট ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে,
ছল করে সাজু দাড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে।
নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে সে যে দিত আনি,
সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি।
সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে,
যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে।
আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে,
দুবারুর মত দুবিয়া দুবিয়া মানিক মুকুতা মাঙে।
এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ এতটুকু হাসি খেলা,
তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা!
হায় অভাগিনী! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল,
তারাই আজিকে ভূজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল।
যে বাঁশি শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি,
দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী।
মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী-
“মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি।”
আরো মনে পড়ে ,”দীন দুঃখির যে ছাড়া ভরসা নাই,
সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই।”
হায় হায় প্তি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন;
সাজুর বেদনা সকলেই শোনে,”শোনে না সে একজন।
গাছের পাতারা ঝরে পড়ে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে,
পাড়া প্রতিবেশি নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে।
হায়রে বধির,তোর কানে আজ যায়না সাজুর কথা;
কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা।
হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূ্রের দেশে,
আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে।
দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাঊয়ের লতা,
পাতাগুলি তার উনিয়া পড়িছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা।
হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলে বাকি,
আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কত্রূপ ফাঁকি।
সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস,
বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস।
নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,
ও যেন তাহার গোপণ ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।
অনেক সুখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,
তার জীবনের ইতিহাস খানি কহিছে রেখায় রেখা।
এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন একদিন,
কৃষাণির ঘরে আদরিণী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন।
স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সে যে,
গুনগুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে।