নক্সী-কাঁথার মাঠ-১৩
সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,
সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই।
খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি,
খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা , আঁকিল সে তার সবি।
আঁকিল কাঁথায়- আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ নারী,
দেখিছে–তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি।
আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে,
বুকে কর হানি,কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে।
এওম্নি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে,
তার চেয়ে সাজু অসয্য ব্যথা আপনার বুকে বহে।
তারপর শেষে এমনি হইল , বেদনার ঘায়ে ঘায়ে,
এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝড়িয়া -বায়ে।
কি যেন দারুন রোগেতে ধরিল , উঠিতে পারেনা আর;
শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়নধার।
হায় অভাগীর একটি মানিক! খোদা, তুমি ফিরে চাও,
এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও!
ফিরে চাও তুমি আল্লা রসূল! রহমান তব নাম,
দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম!
মেয়ে কয়, “মাগো! তোমার বেদনা জানি আমি সব জানি,
তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি!
সোনা মা আমার! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা,
ঘরের মেঝে মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা!
একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূচ সুতা দাও হাতে,
শেষ ছবিখানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে।“
পান্ডুর হাতে সূচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে ,
আঁকিয়া আ&কিয়া আঁখি জল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে।
কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি,
তারি কাছে এক গেয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি;
রাত আন্ধার, কবরের পাশে বসি বিরহীর বেশে,
অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি , বুক যায় জলে ভেসে।
মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বারবার করি,
দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি।
দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি,
“সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি;
এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে!
সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল,
জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল।
হয়তো আমার কবরের ঘুম ভেঙ্গে যাবে মাগো তাতে,
হয়তো তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে।
এ ব্যথে সে মাগো কেমনে সহিবে,বোলো তারে ভাল করে,
তার আঁখিজল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে।
মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই,
আমি গেল মোর কবরের গায় এরে মেলে দিও তাই!
মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে,
জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে।”
বলিতে বলিতে আর যে পারেনা,জড়াইয়া আসে কথা,
অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি মদারুণ ব্যথা!
কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়,
“সাজু সাজু! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয়?”
“আল্লা রসূল! আল্লা রসূল!” বুড়ী বলে হাত তুলে,
“দীন দুঃখীর কান্না এ আজিকে যেয়োনা ভুলে!”
দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে যায় আঁধার রাতের কালি,
উতলা বাতাস ধীরে বয়ে যায়, সব খালি! সব খালি!!
“সোনার সাজুরে , মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে,
তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একলা ঘরে!”
দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে,
রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ায় দাপে।